ছুলি ফাঙ্গাস বা ছত্রাক জনিত ত্বকের একটি রোগ। আমাদের জানা উচিৎ ছুলি থেকে মুক্তির উপায় ও ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম জানতে চাই কিন্তু সঠিক তথ্য পাইনা। আমি আপনাদের ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম গুলো এই আরটিকেলের মধ্যে দিয়ে দিবো।
মেডিকেলের ভাষায় একে Tinea Versicolor বা Pityriasis versicolor বলা হয়। এটি Malassezia Furfur নামক এক প্রকার ঈস্ট দ্বারা আমাদের শরীরে হয়ে থাকে। ছিয়াল/ছুলি/ছলম/ছইদ/ছৌদ/কদম-অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা নাম। এটি মূলত ত্বকের একটি সমস্যা। ছত্রাক সংক্রমণে সমস্যাটি হয়ে থাকে। পিঠ, গলা, হাত, শরীরের বুক, মুখে ও অন্যান্য খোলা অংশ এতে আক্রান্ত হয়। ত্বকের এসব জায়গায় সাদা বা বাদামি, গাঢ় বা হালকা ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ সময় বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে মুখে দেখা দিতে পারে। আসুন যেনে নি,
ছুলি কখন হয়:
বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ও গ্রীষ্মের গরম আবহাওয়ায় এ রোগের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। এ ছাড়াো দীর্ঘদিন যাবত স্টেরয়েড ট্যাবলেট খেলে এ সমস্যাটি আমাদের হতে পারে। আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলেও অনেক সময় এটি হয়। একই কক্ষে অনেক মানুষ থাকলে, একই জিনিসপত্র ব্যবহার করলে ও অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন থাকলেও এ ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে।
ছুলি রোগের লক্ষণ:
আক্রান্ত স্থানে সাদা বা বাদামি গাঢ় অথবা হালকা ছোট ছোট ছোপ ছোপ দাগের মতো দেখা দেয়।সাধারণত ফর্সা ত্বকে গাঢ় (খয়েরী বা গোলাপী ), শ্যামলা ত্বকে হালকা রঙের হয়। অনেকগুলি ছোপ ছোপ দাগ একসাথে হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় গরমকালে গরম বাড়লে চুলকানো বা জ্বালাপোড়া বেড়ে যেতে পারে। সংক্রমণ অনেক বেশী হলে চামড়া উঠতে শুরু হতে পারে। তবে শীতকালে ছুলি অনেকটাই কমে যায়।
ছুলি রোগের কারণ:
- প্রচুর ঘাম হওয়া।
- গরম,আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া।
- দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করলে।
- তৈলাক্ত ত্বক।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
- এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ অনেকদিন যাবত সেবন করলে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে।
- গ্রীষ্ম ও বর্ষাকেলে বেশী হয়।
- সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহার করলে।
ছুলি প্রতিরোধে করনীয়:
- ঘামা অবস্থায় বেশিক্ষণ না থাকা। ঘামে ভেজা থাকা পোশাক তাড়াতাড়ি পাল্টে ফেলা, ঘামা পোশাক টি না ধুয়ে আর ব্যবহার না করা।
- গ্রীষ্মকালে পাতলা, ঢিলেঢালা ও সুতি পোশাক পরিধান করা।
- গোসলের পর গা ভালো করে শুকিয়ে নেওয়া।
- শরীরের যেসব জায়গায় ঘাম বেশি হয়, সেসব জায়গা বারবার ধুয়ে পরিষ্কার ও শুকনো রাখা।
- পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েড সেবন পরিহার করা।
- রোদে গেলে ছাতা ও সানব্লক ব্যবহার করা।
- স্যাঁতসেঁতে আর্দ্র আবহাওয়ায় যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।
- অন্যের ব্যবহৃত তোয়ালে,গামছা,গামছা ইত্যাদি ব্যবহার না করা।
- একই ব্লেড দিয়ে একাধিক ব্যক্তির চুল বা দাঁড়ি না কামানো।
- প্রচুর পানি পান করা।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ছুলি থেকে মুক্তির মহৌষধ।
ছুলি দূর করার ঘরোয়া উপায়:
ছুলির নানা রকম চিকিৎসা রয়েছে। তবে ঘরোয়া উপায়েও এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। রাজধানীর ল্যাবএইড ও পপুলার হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ এবং স্কিন লেজার বিশেষজ্ঞ কিছু পরামর্শই দিয়েছেন।
লেবুর রস: লেবুর রসে রয়েছে প্রাকৃতিক ব্লিচ। এই উপাদান আমাদের চামড়ার রং হালকা করে। ত্বকের গাঢ় বা বড় দাগ দূর করতে সাহায্য করে। লেবু চিপে লেবুর রস নিংড়ে আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে মালিশ করবেন। এভাবে ১০ থেকে ২০ মিনিট রেখে দেবেন। তারপর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এইভাবে প্রতিদিন অন্তত দুবার এটি করে দেখুন।
লেবু-চিনির স্ক্রাব: লেবু-চিনির স্ক্রাব ত্বকের যত্নে বেশ কার্যকরী। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ছুলির দাগ খুব দ্রুত কমে যাবে। একটি লেবু মাঝখান থেকে কেটে নিয়ে অর্ধেক অংশের উপর আধা চামচ চিনি মাখিয়ে নিন। তারপর ত্বকের ছুলি আক্রান্ত অংশে লাগিয়ে আলতো করে আস্তে আস্তে ১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। তারপর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ২ সপ্তাহ নিয়মিত ব্যবহার করলে ছুলির সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।
টমেটোর রস: টমেটোতে রয়েছে একাধিক পুষ্টি উপাদান। বিশেষ করে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন টমেটো ত্বকের যত্নে সেরা ঘরোয়া ঔষধ হিসেবে বিবেচিত। ছুলির দাগ দূর করতেও এই উপাদানটি খুব কার্যকরী। এজন্য একটি পাকা টমেটো অর্ধেক করে নিয়ে ত্বকের ছুলি আক্রান্ত অংশে ব্যবহার করুন। ১০-২০ মিনিট আলতো ভাবে মালিশ করুন। তারপর ভালো পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি ব্যবহারের পরবর্তী ১-২ঘণ্টা পর পর সাবান ব্যবহার করবেন ২ সপ্তাহ ধরে নিয়মিত দিনে অন্তত ২ বার এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ছুলির সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পাবেন।
পেঁয়াজ: চুলের যত্নে পেঁয়াজ একটি বিশেষ উপকারী এক উপাদান। এতে থাকা এক্সফলিয়েটিভ উপাদান ছুলি নিরাময়েও অনেক কার্যকর। একটি বড় মাপের পেঁয়াজ মাঝখান থেকে দু-ভাগ করে অর্ধেক অংশটি নিয়ে শরীরের ছুলি আক্রান্ত স্থানে দিনে অন্তত ২ বার ম্যাসাজ করুন। যত দিন পর্যন্ত ছুলি একেবারে সেরে না যাবে, ততদিন আক্রান্ত স্থানে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করতে থাকুন।
টক দই: টক দইয়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন নিশ্চয়ই। টক দইয়ে থাকা ল্যাক্টিক অ্যাসিড ছুলির দূর করতে ভালো ভূমিকা রাখে। একটি ছোট পাত্রে ২-৩ চামচ টক দই নিন। এরপর কটন বল দিয়ে টক দই আক্রান্ত স্থানে লাগান। ১৫ মিনিট পর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। দিনে দুই থেকে তিনবার এটি করুন
অ্যালোভেরা: ত্বকের অনেক রকম চিকিৎসা ও চর্চার মতো অ্যালোভেরা ছুলি দূর করতেও অনেক বেশী কার্যকর। অ্যালোভেরার জেলি বের করে আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে লাগিয়ে রাখুন। অন্তত ১৫-২০ মিনিট রেখে দেবেন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন।
ভেজিটেবল মাস্ক: ভেজিটেবল মাস্ক ছুলির সমস্যা সমাধানে আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করতে পারেন । এটি তৈরি করতে প্রয়োজন হবে ২ টুকরো শশা, ২ টুকরো স্ট্রবেরি ও অলিভ অয়েল। শশা ও স্ট্রেবেরি ভালো করে ব্লেন্ড করে তার সঙ্গে অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন।মিশ্রণটি ভালো মত হয়ে গেলে ছুলির উপরে ব্যবহার করুন। ত্বকে শুকিয়ে গেলে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। ছুলির সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এবং ত্বকের জেল্লা বাড়াতে সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ বার এই মাস্ক ব্যবহার করুন। এ ছাড়াও পেঁপে, বেগুন,কলা আর পুদিনার মাস্কও ছুলির সমস্যায় বিশেষ কার্যকরী।
ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম:
বাজারে অনেক ধরনের ছুলি দূর করার ক্রিম পাওয়া যায়। যদিও ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোন ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয়। চলুন জেনে নি ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম। ছুলির কিছু ক্রিম রয়েছে যা অনেক ভালো। যেমন ছুলি গার্ড, চালডারম, কেটো ট্যাব। তবে বর্তমানে আসল ঔষধ এর পাশাপাশি অনেক নকল ঔষধ ও পাওয়া যাচ্ছে। তাই গ্রামের নরমাল মেডিসিন থেকে নেয়ার আগে আসল ও নকল ঔষধ দেখে নিতে হবে। আজে বাজে অনেক সাইটে ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম পাবেন। যেইখান এ ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম অনেকগুলো দিয়ে রেখেছে। ভালো ব্র্যান্ড এর গুলাই সাজেস্ট করেছি আমি।
ছুলি দূর করার সাবান:
ছুলি দূর করার ক্রিমের নাম গুলো আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন এখন সাবান ও আতো কিছু ব্যবহারিক প্রোডাক্ট এর নাম দিয়ে দিচ্ছি। আপনি সর্বাধিক সাবধানতার পরেও যদি ছুলি রোগে আক্রান্ত হন, তবে চিন্তার করার কিছুই নেই। সঠিক চিকিৎসায় করলে ছুলি ভালো হয়ে যাবে। তাই অভিজ্ঞ একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং সে অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন সব নিয়ম নীতি মেনে চলুন। বিভিন্নধরন অনুযায়ী ছুলির চিকিৎসায় সাধারণত নিচে লেখা ওষুধগুলো ব্যবহৃত হয়ঃ
- ২% কিটোকোনাজল অথাবা সেলেনিয়াম সালফাইড যুক্ত সাবান বা শ্যাম্পু।
- মুখে খাওয়ার ছত্রাকনাশক ওষুধ।
- ফ্লরি সাবান
- যোডার সাবান
- লক্ষণ অনুযায়ী অন্যান্য ওষুধ।
ছুলি কি ছোঁয়াচে রোগ ?
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধর বলছেন, ছুলি ছোঁয়াচে রোগ। একজনের ব্যবহার করা জিনিস থেকে আর একজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ার মারাত্মক সম্ভাবনা রয়েছে। বাচ্চার গালে বা মুখে ছুলি হলে তার গালে বা মুখে ধরে আদর করলে সেখান থেকেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার সাত দিনের মধ্যেই এই চর্মরোগ টি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তখন আর তা সংক্রামক হয় না। একবার ছুলি হলে প্রতিবছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ঠিক যেমনটি অন্যান্য ফাঙ্গাস বা ছত্রাক জাতীয় অসুখে দেখা দেয়।